অতিপ্রকৃত বড় গল্পঃ জুংগা


মিশু পুকুর পাড়ের সামনে এসে দাড়ালো । হাতে চায়ের কাপ । নিজের জন্য না, পুকুরের বাঁধানো পাড়ে একজন বসে আছে । পুকুরের দিকে মুখ করে এক ভাবে তাকিয়ে আছে পানির দিকে। কাজের মেয়েটার এখানে আসার কথা ছিল কিন্তু কাজের মেয়েটা এক অদ্ভুদ কারনে সামনের মানুষটিকে ভয় করে । সামনে আসতে চায় না ! 

মিশুরও ভয় পাওয়ার কথা কিন্তু মিশু এসবে বিশ্বাস করে না । তবে সামনের মানুষটি বেশ মজার একজন মানুষ । কারন মানুষটির কাজ হচ্ছে ভুত তাড়ানো । সেটাও মিশুর খুব একটা আকর্ষনের বিষয় হত না কিন্তু মানুষটি অন্য সব ভুত তাড়ানো মানুষের মত হত । কিন্তু এই মানুষটি অন্য সবার ধারে কাছ দিয়েও না । প্রথম যেদিন দেখেছিলো তখন বিশ্বাসই হচ্ছিলো না । পরিপাটি ভাবে জিন্সের প্যান্টের সাথে কালো রংয়ের একটা শার্ট ইন করে পরা । মুখে এক দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি তবে সেটা চেহারার সাথে একদম মানিয়ে গেছে । শার্টের ভেতরে একটা সান গ্লাসও দেখা যাচ্ছিলো । এই মানুষকে কোন ফ্যাশন হাউজের মডেল বলে নির্দ্বিধায় চালিয়ে দেওয়া যায় সেখানে সেই মানুষ কি না ভুত তাড়ায় ! মিশুর মানতেই কষ্ট হয়েছিলো তখন । বেশ মজাও লাগছিলো অবশ্য । আধুনিক ভুতের ওঁঝা ! 

মিশু আরও একটু এগিয়ে গেল । তখনই মানুষটা ওর দিকে ফিরে তাকালো । সাথে সাথেই একটু হাসলো ! এই মানুষের হাসি দেখে কেউ কিভাবে ভয় পেতে পারে মিশু ভেবে পেল না । শিউলিটা আসলেই একটা গাধা ! 

মিশুকে দেখে রাফায়েল একটু অবাক হওয়ার ভান করা হাসি দিল । তারপর বলল
-আরে তুমি চা নিয়েছো ? তোমাদের কাজের মেয়েটা শিউলী না কি নাম, সে কোথায় ?
মিশু বলল
-আপনাকে দেখে ও ভয় পায় । প্রথম দিন আপনি নাকি ওকে কি দেখিয়েছিলেন । সেটার পর থেকে আপনার নাম শুনলেই ওর খবর হয়ে যায় ! 
রাফায়েল শব্দ করে হাসলো । তারপর মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল 
-তোমার ভয় লাগে না ?
-আমাকে ভয় দেখানো এতো সহজ না ! 
-সাহসী মেয়ে আমার খুব পছন্দ । যাই হোক চা টা কি আমার জন্য ?
-ও ! হ্যা । মা পাঠিয়েছে ! 
-তাই ? আমি ভাবলাম তুমি চা টা বানিয়েছো ?
-আমি বানিয়েছি কিন্তু মা বলল আর কি ! আপনি নাকি চা চেয়েছিলেন ?
রাফায়েল আবারও কিছু সময় মিশুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-তুমি চা ভাল বানাও । তবে আজকে চায়ে চিনি দিতে ভুলে গেছো । 
-কি ? মোটেই না ! আমি চায়ে চিনি দিয়েছি !
-একটা চুমুক দিয়েই দেখ !

মিশু কিছু সময় রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল
-আপনি কি আমার সাথে কোন ট্রিকস খেলার চেষ্টা করছেন ? যদি করে থাকেন তাহলে বলে রাখি আমি কিন্তু শিউলি না । আমাকে এতো সহজে বোকা বানাতে পারবেন না । 
-এক চুমুক দিয়েই দেখো । 

মিশু আরও কয়েকটা মুহুর্ত রাফায়েলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো । মানুষটার চোখের ভেতরে অন্য রকম কিছু একটা আছে যেটা কোন ভাবেই অগ্রাহ্য করার কোন উপায় নেই । মিশু সেটা ভাবতে ভাবতেই চায়ের কাপে চুমুক দিল । তখনই মনে হল রাফায়েল ঠিক কথাই বলেছে । ও আসলেই চায়ে চিনি দেয় নি । একদমই চিনি দেই নি । একটু না অনেক খানি অবাক হল ও । এমনটা মোটেও হওয়ার কথা না । মিশু চায়ে চিনি ছাড়া খেতেই পারে না । যখনই ও চা বানায় সব সময় সবার আগে চিনি মেশাতে ভুল করে না । ওর বড় বোন মিমি তো বলে মিশু চা নয় শরবতে বানাতেই ভাল পারে । 

আজকে কি ও চিনি দিতে ভুলে গেল ?
নাহ । এমনটা হতে পারে না । 
তাহলে ?
তাহলে সামনের বসা মানুষটার কি কোন হাত আছে এতে !
নাহ । এমন কোন হাত নেই । ও নিশ্চয়ই ভুলে গেছে চিনি দিতে । এমন হতেই পারে । 

মিশু বলল
-আমি নতুন করে বানিয়ে আনছি !
রাফায়েল বলে উঠলো 
-কোন দরকার নেই । এই চা ই চলবে !
-আরে আমি মুখ দিয়েছি । আমার এটো আপনি খাবেন কেন ?
-আমি বললাম তো সমস্যা নেই । দাও চায়ের কাপটা আমার কাছে !

অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও মিশু চায়ের কাপটা রাফায়েলের হাতে দিল । এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সে চায়ে চুমুক দিতে শুরু করেছে । এবং এমন একটা ভাব করছে যেন চা খেতে বেশ মজা হয়েছে । 

মিশুর কেমন যেন লাগছে শুরু করলো । একবার মনে হল এখান থেকে চলে যেতে কিন্তু সেটা করলো না । রাফায়েলের পাশে বসলো । তারপর বলল
-আপুর ব্যাপারে কি হল ?
-যা ভেবেছিলাম তাই ।
-সত্যিই ?
-হ্যা ! তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না তবে এটাই সত্যি । 


মিশু কি বলবে খুজে পেল না । গত ৬ মাস ধরে ওদের ফ্যামিলির সব কিছু যেন কেমন ওলট পালট হয়ে গেছে । সব সময় হাসি খুশি থাকা ওর বড় বোন মিমি হঠাৎ করেই লক্ষ্য করা শুরু করলো ও শরীরে জোর পাচ্ছে না । সপ্তাহ যেতে না যেতেই একেবারে বিছানায় পরে গেল । দেশের সব থেকে বড় বড় ডাক্তার দেখানো হল, যাওয়া হল বাইরেও কিন্তু কোন কাজই হল না । দীর্ঘ চার মাস চিকিৎসা করার পরে ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিল । তারা কোন কিছু বুঝতে পারছে না । শেষে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন । দিন দিন মিমির প্রানশক্তি কমে আসছিলো । সে যে কদিন পরেই মারা যাবে সেটা বুঝতে আর কারো বাকি রইলো না । তাই ওরা ওদের ঢাকার বাসা ছেড়ে মুন্সিগঞ্জের এই বাগান বাড়িতে এসে উঠেছে । এটা মিমির অনেক পছন্দের একটা স্থান । সময় সুযোগ পেলেই দুবোন মিলে এখানে চলে আসতো । এখানে পুকুর পাড়ে বসে থাকতো নয়তো গ্রামের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতো । শেষ দিন গুলো এখানেই কাটুক ওর । 

এখানে এসেই ওদের কেয়ারটেকারের কাছ থেকে রাফায়েলের কথা শুনতে পায় ওদের মা । ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটা যা পায় সব ধরে বেঁচে থাকতে চায় ঠিক তেমনই ওদের মা জোবাইদা বেগমও মেয়েকে বাঁচানোর জন্য রাফায়েলকে খবর দিলেন । 
রাফায়েল এসে হাজিরও হল । তখন ওকে দেখে কেবল মিশু কেন বাসার কারোই ঠিক বিশ্বাস হয় নি যে এই মানুষ ভুত তাড়ানোর ওঁঝা হতে পারে । 

প্রথম দিন রাফায়েল কারো সাথে তেমন কোন কথা বলে নি । কেবল কাজের কথা বলে মিমির রুমে বসে ছিল অনেকটা সময় । একেবারে চুপ করে । মিমির ঘুমন্ত চেহারার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে ছিল । মিশু নিজেও সেই রুমে ছিল । রাফায়েল কি করলো কেউ জানতেও পারলো না । প্রায় ঘন্টা দুয়েক পার হওয়ার পর যেন রাফায়েলের ধ্যান ভাঙ্গলো । সে জোবাইদা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনারা এতো দেরি কেন করলেন ? শুরু দিকেই আমাকে খবর দিলে অবস্থা এতো খারাপ হত না !

-কি করতে তুমি ? 

কথাটা মিশুর বাবা আলতাফ মাহমুদ বলল । 
-দেশ বিদেশে বড় বড় ডাক্তার যেখানে কি করতে পারলো না, তুমি কি করবে ? ফু দিয়ে আমার মেয়েকে ঠিক করে দিবে ?

মিশু বলল
-বাবা প্লিজ ! 
-আমার মেয়েটাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও তোমরা ! তোমরা কেউ কি বুঝতে পারছো না যে ...

মিশু জানে উপরে উপরে ওর বাবা যতই কঠিন থাকার চেষ্টা করুক না কেন, সব থেকে তিনিই ভেঙ্গে পড়েছেন । এভাবে চোখের সামনে নিজের মেয়েকে চলে যেতে দেখা এবং বাবা হয়ে কিছু করতে না পারা, কত যে কষ্টের একটা ব্যাপার কেবল সেটা তিনিই বুঝতে পারছেন! জোবাইবা বেগম স্বামীকে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেল । মিশু ভেবেছিলো রাফায়েল রাগ করে চলে যাবে তবে রাফায়েলের মুখ দেখে মনে হল এমন ঘটনা ওর জন্য খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ! মিশু বলল
-আপনি প্লিজ বাবার কথায় কিছু মনে করবেন না ।
-না মনে করার কিছু নেই । আমার অভ্যাস আছে এরকম কথা শুনে । পরে উনি নিজের ভুল বুঝতে পারবেন ।
মিশু বলল
-আপনার কি মনে হচ্ছে ?
-কেউ তোমার বোনকে কালো জাদু করেছে !

যদি কালো উর্দি পরা মানুষের মুখ থেকে এই কথাটা শুনতো তাহলে মিশুর খুব একটা অবাক লাগতো না তবে এমন ফিটফাট পোশাক পরা কারো কাছ থেকে এমন কথা আসলেই ওর কাছে কেমন বেখাপ্পা লাগছে । রাফায়েল বলল
-আচ্ছা তুমি আমাকে ঠিক বলতো ঠিক কোন দিন থেকে এমন শুরু হয়েছে ? 

মিশু ঠিক ঠিক তারিখ আর দিনটা বলে দিল । 
রাফায়েল বলল
-এরকম ঠিক ঠিক তারিখ কিভাবে মনে রাখলে । ডায়রি লিখতে ?
-না ! আসলে ঐ দিনের আগের দিন আপুর পোষা বেড়ালটা মারা গিয়েছিল !
-বেড়াল !

বেড়ালের কথা শুনেই রাফায়েলের মুখটা একটু যেন অন্য রকম হয়ে গেল । সেটা মিশুর চোখ এড়ালো না । মিশু বলল
-হ্যা । আসলে বেড়ালটা আপু জন্ম দিনে উপহার পেয়েছিল । ফাহিম ভাইয়া দিয়েছিলো । আপুর সাথে পড়ে, খুব ভাল বন্ধু ওরা । মাত্র এক সপ্তাহ আগে ফাহিম ভাইয়া মিমি আপুকে বেড়ালটা উপহার দিয়েছিল । তারপর যখন বেড়ালটা মারা গেল আপু খুব কেঁদেছিল । বেড়ার মারা যাওয়ার ঠিক পরদিনই আপুর এই সমস্যাটা দেখা দেয় ! শরীরে বল পায় না ।

সেদিন আর কিছু জানতে চায় নি রাফায়েল । কেবল ফাহিমের নাম ঠিকানা আর ফোন নম্বর নিয়ে গিয়েছিলো । তারপর আরও দুদিন এই বাসা এসেছিল তবে খুব বেশি সময় থাকে নি । পুরো এক সপ্তাহ পরে আজকে আবার এসে হাজির । 


মিশু আরও অনেকটা সময় রাফায়েলের সাথেই পুকুর পাড়ে বসে রইলো । কোন কথা হল না অবশ্য দুজনের ভেতরে । মিশুর অবশ্য এখনও এই সময় কালো যাদু টাইপের কথাতে বিশ্বাস নেই তবে কেন জানি ওর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে । কারন এটা ছাড়া আর কোন ব্যাখ্যা ওর কাছে নেই । ওর কেন কারো কাছে নেই । 

রাফায়েল হঠাৎ উঠে দাড়ালো । তারপর মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল
-চল তোমার বাবা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে । আমি যা জানতে পেরেছি সেটা তাকে বলা দরকার !
-আপনি কিভাবে বুঝলেন বাবা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে !

এই কথা বলতে না বলতেই ওর চোখ ওদের বাসার দিকে গেল । দরজায় ওদের কাজের মেয়েটাকে দেখা গেল পর মুহুর্তেই । ওদের দিকে তাকিয়ে শিউলি চিৎকার করে বলল
-সাহেব আপনারে ডাকে !

এই লাইণ বলেই শিউলি আবার দ্রুত ভেতরে চলে গেল । ওর চোখের ভীত ভাবটা মিশুর চোখ এড়াই নি । ততক্ষনে রাফায়েল হাটা শুরু করে দিয়েছে । চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে মিশু পেছন পেছন হাতে লাগলো । চায়ের কাপের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে কিছুটা সময় । চা একেবারে শেষ হয়ে গেছে । সেখানে কয়েকটি চিনির দানা এখনও অগলিত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে !
তার মানে ও ঠিকই চায়ে চিনি দিয়েছিলো !! 
কিন্তু চা তখন এমন পানসে কিভাবে লাগলো !!

মিশুর কেন জানি শরীরটা একটু শিরশির করে উঠলো । চারিদিকটা একদম নির্জন হয়ে আছে ! সে একটু জোরে পা চালিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল ! 






দিবার কাছে বেড়াল ছানাটা দেখে ফাহিম অবাক না হয়ে পারলো না । ফাহিম যতদুর জানে দিবা পোষা প্রাণী বিশেষ করে কুকুর বেড়াল টাইপের প্রাণী একদম সহ্য করতে পারে না । তাহলে আজকে ওর কাছে এই বেড়াল ছানা কেন ?
-আজকে কি হয়েছে তোমার ? বিড়াল কেন ?
দিবা একটু হাসার চেষ্টা করলো তবে সেটা খুব একটা কাজে এল না । মেয়েটা যেন কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত । দিবা বলল
-আমার জন্য না । এটা মিমির জন্য !
-মিমি ? 
-আজকে ওর জন্মদিনের পার্টিতে যাচ্ছো না তুমি ?
-কেন, তুমি যাচ্ছো না ?
-না । আমার একটা কাজ পড়ে গেছে । সেখানে যেতে হবে । মিমিকে ফোন দিয়েছিলাম ওতো আমার উপর রেগে আগুন । কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে । 

ফাহিম হাসলো । মিমির সব কিছুতেই ফাহিমের একটা নিরব সম্মতি আছে । ফাহিম বলল
-তো আমাকে কি করতে হবে ?
-এটা নিয়ে ওকে দিবে কিন্তু বলবা না যে আমি দিয়েছি । ঠিক আছে ? বলবা তুমি দিয়েছো ।
-কেন ? সমস্যা কি ?
-সমস্যা আছে । কদিন পরে আমিই ওকে বলবো নে ! ঠিক আছে ?
-আচ্ছা ! 

ফাহিম আর কথা বাড়ালো না । বেড়ালটা নিয়ে রওনা দিল মিমির বাসার দিকে । ফাহিমকে চলে যেতে দেখলো । একবার মনে হল ও কাজটা করতে করতে যাচ্ছে সেটা বন্ধ করার এখনও উপায় আছে । এখন যদি দৌড়ে গিয়ে ফাহিমকে আটকায় তাহলেও আর কিছু হবে না । কিন্তু ও কাজটা করলো না । কাজটা ওকে করতেই হবে । ওর চোখের সামনে দিয়ে ওর ভালবাসার মানুষটা অন্য কাউকে পছন্দ করবে সেটা ও কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না । অন্তত এভাবে চোখের সামনে ফাহিমকে চলে যেতে দিতে পারে না । 

দিবা খুব ভাল করেই জানে যে ফাহিম কেন মিমিকে পছন্দ করে । চেহারার কথা বিবেচনা করলে মিমি কোন দিনও দিবার সাথে পারবে না । কিন্তু তবুও ফাহিমের পছন্দ মিমিকেই । মিমির বাবা দিবার বাবার থেকে অনেক বেশি বড়লোক । মিমির গাড়িটার দাম ওর গাড়িটার থেকেও অনেক বেশি । দিবা এটা মেনে নিতে পারছে না । এটা ওকে করতে হবেই । মিমির জন্য যে ওর খারাপ লাগছে না সেটা না তবে ও এটার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেক দিন থেকেই । 

যে কাজটা ও করতে যাচ্ছে সেটার বীজ ও গতকালকেই বুনে দিয়ে এসেছে । আজকে সব শেষ ধাপটা ! বেড়ালটা কেবল মিমির হাতে পৌছালেই হবে । ব্যাস ! তার পর বাকি কাজ এমনি এমনিই হবে ! 





আলতাফ মাহমুদ রাফায়েলের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । একটু যেন বিরক্ত । রাফায়েলকে সে ঠিক পছন্দ করে না । তার এসবে ঠিক বিশ্বাস নেই । তবুও তার স্ত্রী এবং মেয়ের কথা চিন্তা করে তিনি কিছু বলছেন না । কিন্তু একটু আগে সে যা বলেছে সেটা তার কাছে বুলশিট ছাড়া আর কিছুই মনে হয় নি ।
আলতাফ মাহমদ বলল
-তো তুমি বলতে চাও আমার মেয়েকে তার সব থেকে কাছের বন্ধু দিবা কালো যাদু করেছে ! কেন করেছে ? কারন সে ফাহিমকে পছন্দ করে কিন্তু ফাহিম পছন্দ করে মিমিকে । এই জন্য মিমিকে পথ থেকে সরানোর জন্য এই কাজ করেছে ?
রাফায়েল খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
-জি !
-তুমি কি জীবনটা বাংলা সিনেমা পেয়েছো ? আর আমরা বাংলা সিনেমার দর্শক ! যা বলবে যা গেলাবে তাই গিলবো ! তোমার টাকার দরকার আমাকে বল । আমি দিচ্ছি তবুও প্লিজ এমন বেহুদা কথা বার্তা বল না ! 
-আমি জানতাম আপনি বিশ্বাস করবেন না । তবে এবার আমি যাতে আপনি বিশ্বাস করেন সেই ব্যবস্থা করেই এসেছি । 

এই বলেই রাফায়েল নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো । তারপর সেটাতে কিছু সময়ে কি যেন টেপাটেপি করে একটা ভিডিও বের করলো । এবার সেটা চালু করে আলতাফ মাহমুদের সামনের টেবিলে রাখলো । 

কালো স্ক্রিনের সামনে একটু পরেই দিবাকে দেখা গেল । মেয়েটা কাঁদছে । মিশু সেই সাথে জোবাইদা বেগমও সরে এল স্ক্রিনে কি আছে দেখার জন্য । ভিডিওতে দিবা তখন কথা বলতে শুরু করেছে ।

-আই এম সরি আঙ্কেল ! 
দিবা কাঁদতে কাঁদতে বলছে কথা গুলো ।
-আমি কোন দিন ভাবি নি মিমির এই অবস্থা হবে । আমি কেবল ওকে কিছু দিনের জন্য বিছানার আটকে রাখতে চেয়েছিলাম । যাতে আমি ফাহিমকে এই সময়ের ভেতরে নিজের করে নিতে পারি । আমি কোন দিন বুঝতে পারি নি ব্যাপারটা এরকম চলে যাবে ! এই দিকে চলে যাবে ...... 

সবাই দেখলো দিবা কান্না আর কথাই বলতে পারলো না । 

ফোনটা বন্ধ করে রাফায়েল কিছুটা সময় সবার দিকে তাকিয়ে রইলো । কারো মুখে কোন কথা নেই । সবাই এখনও ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করে নিতে পারছে না । রাফায়েল বলল
-আমি যখনই বিড়ালের কথা শুনলাম তখনই ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছিলাম । ব্যাপারটা ভাল কিছু নয় কোন ভাবেই । তারপর খোজ খবর নিতে শুরু করলাম । দিবাকে একটু চাপ দিতেই ও সব বলে দিল ।
-এখন ?

কথাটা বলল আলতাফ মাহমুদ ! রাফায়েলের মুখ বেশ খানিকটা চিন্তিত মনে হল । ও মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল
মিমির ভার্সিটি যাওয়ার একটা ব্যাগ আছে না ? কালো আর বেগুনি রংয়ের ?
-হ্যা ! 
-ওটা নিয়ে এসো ! 

মিশু যেন দৌড় চলে গেল । ফিরে এল একটু পরেই । রাফায়েল ব্যাগটা উপুর করে সব কিছু ফেলে ছিল । তারপর সেটা খানিকটা উল্টে সেখান ভেতরের দিকটা বাইরে বের করে আনলো । কালো অংশের প্রথমে কিছু দেখা না গেলেও রাফায়েল হাত দিয়ে দেখানোর ফলে সবাই দেখতে পেল । একটা কালো রংয়ের মোটা টেপ মারা রয়েছে । এবং টেপের মাঝের কিছু অংশ ফুলে আছে । দেখে মনে হচ্ছে সেখানে কিছু আটকে রাখা হয়েছে । 
টেপটা খুলে ফেলতেই দেখান থেকে ঝুড়ঝুড় করে কিছু পড়লো টেবিলের উপর । রাফায়েল তুলে দেখালো । 
চুল ! 
রাফায়েল বলল
-এটা মিমি ! কালো জাদু করার জন্য এটা করা হয়েছে ! 
-তাহলে এখন কি আপু ঠিক হয়ে উঠবে ?
রাফায়েল মাথা নাড়ালো ! বলল
- ব্যাপারটা এতো সহজ না । কোন কোন ক্ষেত্রে উঠতো তবে এই ক্ষেত্রে না !


উঠে দাড়িয়ে একটু পায়চারি করে আবার নিজের সোফাতে এসে বসলো রাফায়েল । তারপর বলল
-কালো জাদু দুই ভাবে করা যায় । একটা পদ্ধতি খুব সহজ । কেবল ভিটটিমের শরীরের কোন অংশে এভাবে সংগ্রহ করে তার বসবাসার আশে রেখে দিতে হয় । এটা করা যেমন সহজ ঠিক তেমনি ভাঙ্গাযও সহজ । কিন্তু এই ক্ষেত্রে, দিবা খুব খারাপ একটা কাজ করেছে । যা করেছে না বুঝে করেছে তবে খুব খারাপ হয়েছে কাজটা ! 
সবাই কোন কথা না বলে কেবল চুপ করে রাফায়েলের কথা শুনে যাচ্ছে । 

রাফায়েল বলেই চলেছে 
-যখন এভাবে কালো জাদু করা হয় তখন আমাদের এই পৃথিবীতেই থাকা বেশ কিছু নেমেটিভ এনার্জি কিংবা অপ-আত্মা এসে ভিটটিমের উপর ভর করে । তাই তাদের কাছ থেকে ভিটটিমকে রক্ষা করা খুব একটা কঠিন হয় না । কিন্তু দিবা যেটা করেছে সেটা অন্য কিছু । 
মিশু বলল
-কি রকম ?
-ও পৃথিবীর কোন অশুভ আত্মাকে ডেকে নিয়ে আসে নি । অন্য জগতের এক অপদেবতাকে ডেকে নিয়েছে । আমাদের এই জগতে বেড়াল প্রাণীটাকে খুব অশুভ হিসাবে দেখা হয় । আর যারা কালো জাদু করে তাদের জন্য এই বেড়াল হচ্ছে অন্যতম বড় একটা উপাদান । এই অশুভ আত্মারা ঠিক আমাদের জগতে বাস করে না । একটা দেওয়াল দিয়ে সেয়া আলাদা করা । এদের জগৎ আর আমাদের জগতের মাঝে একটা দরজা খোলা সম্ভব ! সেটা এই বেড়ালের মৃত্যুর মাধ্যমে । উপযুক্ত রিচুয়্যাল করলে এটা সম্ভব । এর জন্য দরকার পানি একটা বিড়ালের আত্মাহুতি । দিবার উপহার দেওয়া বেড়ালটা নিশ্চয় পানিতে ডুবে মারা গেছে ?

জোবাইদা বেগম আর আলতাম মাহমুদ কোন কথা বলছেন না । তাদের মুখে এখনই ঠিক অবিশ্বাসের একটা রেখে দেখা যাচ্ছে । আবার তারা এটা না মেনে পারছেনও না ! 
মিশু বলল
-হ্যা ! আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম । আপুর বাথটাবে যখন বেড়ালটাকে মৃত অবস্থায় পেলাম । এমনটা তো হওয়ার কথা না, তাই না ? বিড়াল তো বাথটাবের মত জায়গাতে ডুবে মরতে পারে না !
-হ্যা ! হওয়ার কথা না কিন্তু এমনই হয়েছে । এভাবে জুংগাকে ডেকে আনা হয়েছে । সে তোমার আপুর এই জগতের আত্মাকে টেনে নিয়ে গেছে নিজের জগতে । বেড়ালের মৃত্যুর ফলে যে দরজাটা খুলেছে সেটা দিয়ে ! তবে আশার কথা হচ্ছে এখন সেটা পুরোপুরি যায় নি । ভিটটিম যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন দরজাটা খোলা থাকবে ? মারা গেলে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে !

-কি রকম ?

রাফায়েল উঠে দরজার কাছে চলে গেল । তারপর নিজের হাতটা দরজার মাঝে দিয়ে সেটা বন্ধ করার চেষ্টা করলো । তারপর বলল
-দেখুন আমি ভেতরে আছি । কেউ যদি এখন দরজাটা বন্ধ করতে যায় তাহলে সেটা কোন ভাবেই বন্ধ করা সম্ভব না । এভাবেই এই জগতের সাথে ও জগতের সংযোগ রয়েছে । যখনও আমি হাত সরিয়ে নেব কিংবা আমি দরজা দিয়ে চলে যাবো তখন দরজা টা বন্ধ করা যাবে । ঠিক তেমনই ভাবে মিমির ভেতরে যখন আর কিছু থাকবে না তখন জুংগা ওকে টেনে নিয়ে যাবে । দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবে । এবং আমাদের এই দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই যা করার করতে হবে ।

আলতাফ মাহমুদ বললেন
-কিছুই কি করার নেই ? কোন ভাবেই আমার মেয়েটাকে বাঁচানো কি সম্ভব ?
-সম্ভব ! তবে সেটা অনেক বড় একটা ঝুকির কাজ !
-যে কোন ঝুকি আমি নিতে প্রস্তুত । যত টাকা লাগে আমি খরচ করবো !
-দেখুন টাকা দিয়েই সব কিছু সম্ভব না । আমি টাকা দিকে কাউকে বলতে পারেন না যে, যাও মর ! আর কাজটা এমনই কঠিন !

আলতাফ মাহমুদ একটু যেন বিমর্ষ হয়ে গেল । একটু আগে তার চোখে যে আশার আলো দেখা গেছিলো সেটা নিভে গেছে । রাফায়েল বলল
-আমাদের হাতে কেবল একটা পজেটিভ দিক আছে । সেটা হচ্ছে এই জুংগার মেয়েদের আত্মার উপর ভীষন লোভ ! নতুন কাউকে পেলেই সে পেছনের আত্মার উপর থেকে খানিক্ষনের জন্য কব্জা ছেড়ে নতুনটাকে ধরতে আসে । আমাদের এই সময়ের ভেতরেই মিমির চারিদিকে একটা বলয় তৈরি করতে হবে যাতে জুংগা যখন আবার ফিরে আসে তখন আর ওকে স্পর্শ না করতে পারে ! 
-তাহলে কর ! সেটা কর ! কি কি করতে হবে আমাকে বল ! 
-তার জন্য আমাদের একটা টোপ বিছাতে হবে ।
-টোপ ?
-হ্যা ! টোপ । এবং সেটা কোন মেয়ে হওয়া লাগবে !






মিশুর কাছে ওদের বাগান বাড়ির পুকুর পাড়টা কোন দিন ভয়ের কোন জায়গা ছিল না কিন্তু আজকে ওখানে যেতে ওর একটু একটু ভয় ভয় করছে । রাফায়েল ওকে ওখানে গিয়েই অপেক্ষা করতে বলেছে । সেখান থেকেই ওদের যাত্রা শুরু হবে !
অন্য জগতের যাওয়ার রাস্তা টা ওখানেই আছে ! 

রাফায়েল প্রথম যখন টোপের কথাটা বলল ওরা কেউ ই ঠিক মত বুঝতে পারে নি । কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারলো তখন কারো মুখেই কোন কথা ছিল না । জুংগা নামের সেই অপদেবতাটা একটা দুর্বলতা আছে । এবং সেটা হচ্ছে মেয়েদের আত্মার উপর তার লোভ । অন্য সকল অশুভ দেবতারা যখন কাউকে ধরে, বাধ্য কারা না হলে তার জীবন রস পুরো টুকু শুসে না নিয়ে তাকে ছাড়ে না । কিংবা একই সাথে অনেককে ধরার ক্ষমতা রাখে কিন্তু বেশি লোভের কারনে এই জুংগা তেমনটা করে না । একজনের উপর ভর করে থাকা অবস্থায় যদি নতুন কারোর সন্ধ্যান পায় কিংবা তার টেরিটোরির ভেতরে চলে তাহলে কোন মেয়ে তাহলে আগের জনকে ছেড়েই সেই নতুন জনের পেছনে চলে আসে । এবং নতুনকে ধরে নিয়ে আবার আগের জায়গাতে নিয়ে যায় । 

এইটাই হচ্ছে পয়েন্ট । নতুন জনের উপর ভর করার জন্য কিছু সময়ের জন্য পুরো ভিট টিমকে ছেড়ে আসে বেশি লোভের কারনে । এই চলে আসা এবং ফিরে যাওয়ার সময় মেয়েটার বডি একদম জুংগার প্রভাব মুক্ত থাকে । যদি প্রোজেশনটা অল্প কয়েক দিনের হয় তাহলে খুব অল্প সময়ের ভেতরেই মেয়েটার নিয়ে যাওয়া আত্মা কিংবা প্রানরস যাই বলেন না কেন, সেটা আবার নিজের শরীরে ফেরৎ চলে আছে এবং জুংগা যখন আবার ফেরৎ যায় তখন কাউকে পায় না । আসতেও পারে না কারন দরজা ততক্ষনে বন্ধ হয়ে গেছে !

জোবাইদা বেগম বললেন 
-তাহলে এভাবে মিমিও ফিরে আসতে পারবে ?
-হ্যা পারবে । যখন জুংগা ওকে ছেড়ে অন্য কারো কাছে চলে যাবে তখনই ওর প্রানরস ঐ জগত থেকে এই জগতে আসতে শুরু করবে ! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও অনেক দিন ধরে জুংগার কাছে আটকা রয়েছে এবং ওর জীবনী শক্তির অনেকটাই চলে গেছে ওপারে । এভাবে আসতে সময় লাগবে । অনেক সময় লাগবে এবং এতো জুংগাকে ধাঁধায় রাখার কোন উপায় নেই ।
-তাহলে ?
-সেটারও উপায় আছে । ওর চারিপাশে একটা খাঁচার মত সৃষ্টি করতে হবে । যাতে সেখানে জুংগা ঢুকতে না পারে !

এই কথা শুনে আলতাফ মাহমুদ বললেন
-তাহলে কর ! করছো না কেন ? আমি তো বলেছি যা যা দরকার সব আমি নিয়ে আসবো সব ব্যবস্থা করবো ! 
রাফায়েল বলল
-আপনি মনে হয় আসলে সমস্যা টা এখনও বুঝতে পারেন নি ! টোপটা হবে কে ? কে যাবে ?

এই লাইনটা বলে রাফায়েল চুপ করে গেল । ও কি বলতে চাচ্ছে সেটা বাকিদেরকে বুঝতে দিতে চাচ্ছে ! 
বেশ কিছু সময় চুপ থেকে মিশু বলল
-আমি যাবো !
-হোয়্যাট ! কি বললি তুই ?
আলতাফ মাহমুদ নিজের ছোট মেয়ের দিকে তাকালো !
মিশু খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল
-আমি টোপ হিসাবে যাবো ! 
-হোয়্যাট ননসেন্স ! এক মেয়েকে বাঁচানোর জন্য আরেক মেয়েকে আমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না । কোন ভাবেই পারি না !
-বাবা, আর কেউ নেই আর তুমি তোমার মেয়েকে বাঁচাতর আর কাকে কবরে ঠেলে দেবে ?
-যে কাউকে দিবো ! কিন্তু তোকে না !

কথা বার্তা আর বেশি দুর এগোই নি । তবে মিশু ঠিক করে ফেলেছিলো তাকে কি করা লাগবে । এবং তাই সে করেছে । রাফায়েল সব ব্যবস্থাও করে ফেলেছে । ওকে বলে দিয়েছে কি কি করতে হবে । রাতে ঘুমানোর সময় ওর কিছুতেই ঘুম আসছিলো না । বার বার মনে হচ্ছিলো যে ও বুঝি আর ফেরৎ আসতে পারবে না । 
না পারুক ! 
ও ওর আপুকে খুব বেশিই ভালবাসে । ওর জন্য সে না চলে যাক ! তবুও সেই ফিরে আসুক ! তবে সব থেকে আশার কথা হচ্ছে রাফায়েল ওর সাথে যাবে । মানুষটার উপর এখনই কেমন একটা ভরশা চলে এসেছে । বিশেষ করে ওর চোখের দিকে তাকালে মিশু অন্য কিছু একটা দেখতে পায় । অন্য কোন একটা অনুভুতি হয় ! 


সব কিছু ঠিক করা হয়েছে । রাফায়েল সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে । পুকুরের পানির ভেতর দিয়েই নাকি ওদের যেতে হবে । কিভাবে যেতে হবে সেটা ওর জানা নেই । অন্য কারোই সে সম্পর্ক ধারনা নেই । একটু আগে সে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছে এখানে । রাফায়েল কঠিন করে বলে দিয়েছে এই সময়ে পুকুর পাড়ে আর কারো থাকা চলবে না কিছুতেই । অবশ্য তাদের জন্য অন্য কাজ আছে । যেহেতু রাফায়েল ওর সাথে যাচ্ছে সেহেতু এখানে মিমিকে বাঁচানোর জন্য যে কাজ গুলো করতে হবে সেটা ওদের কেউ করতে হবে । খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা না । কারন রাফায়েল খুব ভাল করেই বলে দিয়েছে কি করতে হবে এবং কিভাবে করতে হবে ! 



মিশু পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে আছে এক ভাবে । নিজের মনটা শক্ত করে নিয়েছে । ওকে যেতেই হবে । নয়তো সারা জীবন ওর কেবল মনে হবে ওর কাছে একটা উপায় ছিল ওর বড় আপুকে বাঁচানোর জন্য কিন্তু ও চেষ্টা করে নি । যেভাবেই হোক ও যাবে এবং মিমিকে মুক্ত করবেই । এমন কি নিজেকে শেষ করে দিয়ে হলেও । 

মিশু রাফায়েলকে আসতে দেখলো । আজকে রাফায়েল কাল রংয়ের পোশাক পরেছে ঠিক যেমনটা ও পরেছে । কালো টাইট জিন্সের সাথে কালো টিশার্ট । এমন কিছুই পরতে বলেছি রাফায়েল, ঢিলাঢোলা পোশাক পরতে মানা করেছিলো । নিশ্চয়ই কোন কারন আছে ! 

ওর সামনে এসে বলল
-কি প্রস্তুত ?
-হুম !
-ভয় লাগছে ?
-লাগছে !
-ভয় নেই ! আমি আছি । যতক্ষন আছি ততক্ষন তোমার কিছু হবে না । তবে আমি না থাকলে, কি হবে সেটা বলতে পারছি না !
-ভয় দেখাবেন না !
-আমি সাহস দিলাম তো ।
-বুঝতে পারছি । চলেন !

রাফায়েল আকাশের দিকে তাকালো । তারপর চোখ বন্ধ করে কি যেন পড়লো । তখনই মিশু দেখলো কেমন যেন একটা পরিবর্তন হচ্ছে চারিদিকে । বাতাস টা যেন একটু বেশি ভারি হয়ে গেছে । একটু যেন বেশিই অন্ধকার হয়ে গেল মুহুর্তেই ভেতরে । চারিদিকে কেবল সন্ধ্যা । এখনও আলো মরে নি কিন্তু মুহুর্তের ভেতরেই কেমন সব কিছু অন্ধকার হয়ে উঠলো । 

রাফায়েল বলল
-চল ! 
এই বলে ওর হাত বাড়িয়ে দিল । মিশু হাত টা ধরলো । কেমন একটু ঠান্ডা ঠান্ডা মনে হল হাত টা !

ওর হাত ধরেই মিশু আস্তে আস্তে পুকুরের সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলো । 
রাফায়েল বলল
-চোখ বন্ধ কর । তবে হাটা থামিও না !

মিশু তাই করলো । চোখটা বন্ধ করে আস্তে আস্তে পা ফেলতে লাগলো । একে একে সিড়ি দিয়ে নেমে হঠাৎ মিশুর মনে হল ও কোন সমান জায়গা দিয়ে হাটছে, নিচটা অনেকটা নরম নরম । কিছু দুর হাটার পরে রাফায়েল ওকে চোখ খুলতে বলল । চোখ খুলে অবাক হয়ে দেখলো ও পুকুরের মাঝে পানির উপর দাড়িয়ে আছে । চোখ বড় বড় করে তাকালো ও রাফায়েলের দিকে । রাফায়েলের চেহারায় কোন পরিবর্তন এল না । রাফায়েল বলল
-বড় করে নিশ্বাস নাও !

মিশু তাই নিল এবং তখনই ওর দুজনেই পানির নিচে তলিয়ে গেল । মিশুর কাছে মনে হল ওর সারা শরীরের খুব ঠান্ডা পানি যেন চারিদিক চেপে ধরেছে । ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে । তবে এখনও ওর কব্জির কাছে রাফায়েলের ধরা হাতটা ও অনুভব করতে পারছে । এইটাই আপাতত বুকে ওকে সাহস জোগাচ্ছে । কিন্তু যখন একটা সময় ওর মনে হল ও যেন অনন্তকাল ধরে ঠান্ডা পানির ভেতরেই রয়েছে । যখনই ওর মনে হল ও আর দম ধরে রাখতে পারবে না তখনই ও আবারও নিজেকে আবারও পানির উপর আবিষ্কার করলো । এবং পানিতে পা দিয়ে ও আর রাফায়েল দাড়িয়ে আছে । নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওদের জামা কাপড় একদম শুকনো । ওরা একটু আগে পানির ভেতরে ছিল সেটা কোন ভাবেই প্রমান করার উপায় নেই ।
জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতে মিশু বলল
-কি হল এটা ? কি হচ্ছে ?
রাফায়েল স্বাভাবিক কন্ঠে বলল
-এখন থেকে অনেক কিছুই হবে যার কোন ব্যাখ্যা নেই । আসো আমরা চলে এসেছি !

এতোক্ষনে মিশির চারিদিকে তাকানোর সময় হল । এটা কোন ভাবেই ওদের পরিচিত সেই পুকুর পাড় নয় । পুকুর তো নয় যেন এটা কোন বড় নদী । খুব দুরে পাড় দেখা যাচ্ছে । রাফায়েল সেদিকে হাটা দিয়ে দিয়েছে । মিশুর পানির উপরেই দৌড়াতে লাগলো রাফায়েলকে ধরার জন্য । চারিদিকটা কেমন শীতের সকালের মত লাগছে । কুয়াশা কারনে ঠিক দেখা যাচ্ছে না । তবে সেই কুয়াশার ভেতরে একটা সিগ্ধ ভাব থাকে এই কালো কুয়াশার ভেতরে রয়েছে অশুভ একটা কিছু । 

পাড়ে এসে রাফায়েল ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-এবার তোমার একলা যেতে হবে ?
-মানে ?
-মানে হল আমি তোমার সাথে যেতে পারবো না । তবে আমি তোমার উপর চোখ রাখার চেষ্টা করবো ! ঠিক আছে ? মনে রাখবে এটা জুংগার রাজ্য । সব কিছুতেই তার ক্ষমতার থাকবে তবে তোমাকে সাহায্য করার জন্য কিছু আছে এখানে । ওকে দেখা মাত্র তোমার কাজ হবে দৌড়ানো । ও যেন কোন ভাবেই তোমাকে আটকে না ফেলে । 
-কিন্তু আমি ওকে চিনবো কিভাবে ?
-দেখলেই চিনতে পারবে । আর এই যেখানেই যাও এই পুকুরের কাছে আসতে হবে, দিক ঠিক রেখো । ও যদি তোমাকে তাড়া করে সোজা এসে এই পুকুর ঝাঁপ দিবা । তাহোলে ওপাড়ে তোমাদের পুকুরে গিয়ে উঠবা ! যদি পেছনে ও আসে আমার জন্য অপেক্ষা করবা না । কেমন ! 
মিশু মাথা ঝাকালো । বলল
-কিন্তু ওকে খুজে পাবো কিভাবে ?
-তোমার খুজে পাওয়া লাগবে না । তুমি যে এখানে ঢুকে পড়েছো এটা এখনই টের পেয়ে গেছে । ও তোমার খোজে চলে আসবে !
মিশুর পুর শরীর জুড়ে একটা ঠান্ডা ভয়ের অনুভুতি প্রবাহিত হল । জানে না সামনে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে । 
-গুড লাক ! 

মিশুর ইচ্ছে হল এখনই পেছন ঘুরে বড় পুকুরটাতে ঝাঁপ দেয় । কিন্তু সেটা করলো না । রাফায়েলকে পেছনে রেখেই হাটতে লাগলো সামনে দিকে । সামনে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে ও সেটা জানে না । যতই সামনে এগোতে লাগলো ওর মনের ভয় টা ততই বাড়তে লাগলো ! 




জোবাইদা বেগম তোজবি নিয়ে বসে আছেন মেয়ের পাশে । একটু আগেও তার চোখ দিয়ে পানি পরছিলো । এক মেয়ে মৃত্যুর কোলে শুয়ে আছে আর অন্য দিকে আরেক মেয়ে মৃত্যুর দিকেই ছুটে গেছে । বোনের জন্য এমন ভাল বাসা দেখে জোবাইদা বেগমের মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিলো কিন্তু সেটা মাত্র কয়েক মুহুর্তের জন্যই । তার পরেই উপলব্ধি হল যে তিনি হয়তো তার দুই মেয়েকেই হারাতে পারেন । এই বৃদ্ধ বয়সে তখন তিনি কাকে নিয়ে থাকবেন ! 

তার স্বামী আলতাফ মাহমুদ হাতে হাতুড়ি আর পেরেক নিয়ে বসে আছে । রাফায়েল যাওয়ার সময় তাকে কঠিন একটা কাজ দিয়ে গেছেন । সেটা করার মাধ্যমেই মিমির জীবন রক্ষা পেতে পারে । কাজটা সহজ তবুও তাকে সঠিক সময়ে কাজটা করতে হবে ।

মিমিকে ফ্লোরের উপর শোয়ানো হয়েছে । ওকে ঘিরে ঠিক ২৩টা মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে । এবং স্বামী স্ত্রী সহ বাড়ির কাজের মেয়ে সবাই অবাক হয়ে দেখেছে যে দেখেছে ২৩ টা মোমোবাতির জ্বালানোর পরে সেগুলোর আগুনের রং মোটেই স্বাভাবিক আগুনের মত নয় । গাঢ় কালো রংয়ের আগুন দেখে ওনারা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সেটার দিকে । রাফায়েল বলল
-এটা কালো দেখাচ্ছে কারন এখানে জুংগা আপনার মেয়ের আত্মার সাথে জড়িয়ে আছে । ঠিক এটাই আপনার কাজ হবে । 
যখনই জুংগা মিমিকে ছেড়ে এসে মিশুর পেছনে আসবে তখনই এই মোমবাতি গুলোর কালো আগুন স্বাভাবিক রং এ ফেরৎ আসতে থাকবে । তখনই আপনার কাজ শুরু হবে ।
-কি করতে হবে ? 
-এই দেখছেন না হাতুড়ি আর পেরেক । আপনার কাজ হবে সেই মোমবাতিরা সরিয়ে সেখানে এই পেরেকটা পুতে দেওয়া । যখনই আপনি ২৩ টা মোমবাতির জায়গাতে ২৩ টা পেরেক পুততে পারবেন তখনই বুঝবেন আপনার মেয়ে নিরাপদ । কিন্তু একটা কথা খুব ভাল করে মনে রাখবেন ! 

এই লাইনটা বলেই রাফায়েল চুপ করে ছিল কিছুটা সময় । তারপর আবার বলা শুরু করলো 
-আমি দরজার মাঝে হাত রাখলে কোন ভাবেই যখন দরজা বন্ধ করা সম্ভব ঠিক তেমনি যদি জুংগার ওকে পুরোপুরি ভাবে ছেড়ে না যায় তখন ও কিন্তু এই পেরেক মেরে ওকে সিকিউর করা যাবে না । মনে থাকবে তো, কেবল মাত্র মোমের আগুনের রং স্বাভবিক মানে নীল কিংবা লাল হলেই আপনি পেরেক পুতবেন !
আলতাফ মাহমুদ বলল
-মনে থাকবে আমার !
-থাকতেই হবে । এটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে !

ওরা চলে গেছে অনেকক্ষন আগে । পুকুর পাড়ে কাউকে যেতে দেয় নি । বাসার সবা কাজের লোককে বাইরে বের করে দেওয়া হয়েছে । কেবল শিউলি মেয়েটা রয়ে গেছে । জোবাইদা বেগম এক ভাবে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন । কত সময় পার হয়েছে সেটা তিনি জানেন না । ঘরের আলো কমিয়ে রাখা হয়েছে যাতে মোমের আগুনের রংটা ভাল করে বোঝা যায় । ঠিক তখনই মিমির পায়ের কাছে একটা আগুন একটু যেন নড়ে উঠলো । তিনি স্বামীর দিকে তাকালেন । চোখ দেখেই মনে হল সেও দেখেছে । কয়েক মুহুর্ত পার হয়ে গেল । তারপরেই কালো রংয়ের আগুনটা রং বদলে গেল । প্রথমে নীল তারপর লালচে নীল হয়ে গেল ! 
-ঐ তো !

আলতাফ মাহমুদের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল । তিনি হাতের পেরেক আর মোম নিয়ে প্রস্তুতই ছিল । হাত দিয়ে মোমটা সরিয়ে সেখানে হাতুরির এক বাড়িতেই পেরেটা পুতে দিল ! 

তার মানে জুংগা মিমিকে ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছে । এই কথাটা মনে হতেও তাদের মনে আরেকটা ভয় বাসা বাঁধলো । যদি মিমিকে ছেড়ে দিতে শুরু করে এর মানে হচ্ছে জুংগা মিশুর দিকে যেতে শুরু করেছে । 
জোবাইদা বেগমের চোখ দিয়ে আবারও পানি গড়িয়ে পড়লো । মনে মনে উপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করলো উপরওয়ালা যেন তার মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখে ! 





প্রথমে মিশু শব্দটা ঠিক পাত্তা দিল না । কারন শব্দটা এসেছে ওর পেছন থেকে । যেদিকে পুকুরটা আছে । ওর মনে হল রাফায়েল ওর পেছনে আসছে । বুকের ভেতরে যেব একটু সাহস পেল । ও সামনে দিকে দিকে এগিয়েই যাচ্ছে । 

জায়গাটার বর্ণনা দেওয়ার কোন উপায় নেই । চারিদিকে ঠিক অন্ধকার হয়ে নেই তবে আলোও নেই ঠিকঠাক মত । আব-ছায়া আলো । সেই কালো কুয়াশার মত । অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যায় কিন্তু স্পষ্ট করে কিছুই দেখা যায় না । ওদের পৃথিবীর মতই সব কিছু । এখানে খুব বেশি গাছ পালা । কিন্তু গাছ গুলো একটু অদ্ভুদ ধরনের । প্রত্যেকটা গাছ বেশ লম্বা । কিন্তু প্রত্যেকটা গাছে দুইটার বেশি ডাল নেই । মানুষের যেমন দুইটা হাত থাকে ঠিক তেমনি । লম্বা দুইটা ডাল । সেই ডালের মাথা থেকে আবার কিছু ডাল বেরিয়ে আছে । এই ডাল গুলো শরীরে বাঁধছে । ভাগ্য ভাল ও টাইট কিছু পরে এসেছে নয়তো এগুলো একটু ঝামেলা হত । 

তখনই আবারও পেছনে আওয়াজ হল । এবার আরও জোড়ে । কেউ যেন কিছু সাথে জোড়ে একটা ধাক্কা খেল কিংবা ধাক্কা মারলো । রাফায়েল হতে পারে না এইটা ! অন্য কিছু ? 
কি ? কোন টা ? 
জুংগা কি তাহলে পেছন থেকে আসছে ? মিশু ঝট করে পেছন ফিরে তাকালো । ওর মনে হল পেছন থেকে কেউ যেন খুব দ্রুত সরে গেল । মিশু নিজের বুকের ধড়ফড়ানীটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলো । এখনই ওকে দৌড় দেওয়া উচিৎ । রাফায়েল বলেছিল যে কোন ভাবেই জুংগার হাতে পরা চলবে না । তবুও আরও কয়েক মুহুর্ত লেগে গেল ওর সিদ্ধান্ত নিতে । সেই সাথে পেছনের পুকুরের কথাটাও ওর মনে রাখা উচিৎ । ঐটাই হচ্ছে ওর এখান থেকে বের হওয়ার এক মাত্র রাস্তা । 

ও দৌড় দেবে কি দেবে না কিংবা দৌড় দিলেও সেটা কোন দিবে এমন কথা যখন ভাবছে তখনই সে জুংগাকে দেখতে পেল । কাউকে বলে দিতে হল না কিন্তু মিশুর বুঝতে একটুও কষ্ট হল না যে এই হচ্ছে জুংগা ! 
মানুষের সাথে কিংবা অন্য কোন প্রাণীর সাথে এই প্রানীর কোন মিলই নেই । দুইটা হাতের বদলে সেখানে চারটা হাত ধরেছে । লম্বায় ওর থেকে অল্প একটু বড় হবে । অসম্ভব মোটা পেট তবে পা দুটো সেই তুলনায় অনেক ছোট । মাথাট ঠিক মাঝ দিয়ে একটা বড় শিং বের হয়ে গেছে । চোখটা শিংয়ের ঠিক নিচেই । কান গুলো অনেক গাধার কানের মত ছড়িয়ে আছে । নাক কিংবা মুখ বলে কিছু নেই সেখানে মসৃন হয়ে আছে ! 

ওকে দেখেই প্রাণীটা অদ্ভুদ শব্দ করে উঠলো । শব্দটা শুনে মনে হল এটা আর যাই হোক পৃথিবীর কোন আওয়াজ হতে পারে না । কিন্তু ও দৌড়াতে পারছে না । ভয়ে ওর পা যেন জমে গেছে । জুংগা ততক্ষনে ওর দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে । ঠিক যখন ওর উপর ঝাপ দিতে যাবে তখনই একটা অবাক করা ঘটনা ঘটলো । দুই হাত বিশিষ্ট লম্বা লম্বা গাছ গুলো একসাথে হয়ে একটা দেওয়া করে মিশুকে আড়াল করে ফেলল । মিশু আবারও সেই চিৎকার শুনতে পেল । কেউ দেওয়া আঘাত করলে যেমন শব্দ হয় তেমন । জুংগা গাছের প্রাচীর ভাঙ্গার চেষ্টা করছে । 

এখন ওর দৌড় দেওয়া উচিৎ ! তখনই ওর হাত ধরে কেউ টান দিল । 
রাফায়েল !!
নাহ ! রাফায়েল না ! একটা গাছ ! ঠিক হাতের মত করে ওর হাত চেপে ধরেছে । চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেল । গাছ টা ওকে সামনে দিকে ধাক্কা দিল যেন ! 
একটা শব্দ উচ্চরন করলো তবে সেটা ওর পরিচিত কোন শব্দ নয় । মিশুর কেন জানি মনে গাছটা ওকে পালাতে বলছে । এবার মিশু সত্যিই দৌড়াতে শুরু করলো । এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ও যেখান দিয়ে যাচ্ছে গাছের সারি গুলো যেন একটু একটু ওকে সরে যাচ্ছে । ওকে জায়গা করে দিচ্ছে । তাররপ ও পার হতেই আবার আগের জায়গাতে চলে যাচ্ছে তারা ! 

গাছ গুলো ওকে সাহায্য করছে !
কিন্তু কেন ?
রাফায়েল অবশ্য বলেছিলো এমন কাউ আছে যারা ওকে সাহায্যও করবে ! এরাই কি তাহলে তারা ?


পেছন জুংগার ভেঙ্গে চুড়ে আসাটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল । মিশুও দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে । একটু দম নিতে লাগলো । 
ঠিক তখনই উপর থেকে কেউ এসে ওর ঠিক সামনে এসে পড়লো । চিৎকার করতে যাবে তখনই দেখতে পেল এটা রাফায়েল !

চোখ ফেটেকান্না চলে এল । জীবন কাউকে দেখে এতো খুশি সে হয়েছে কি না মিশু জানে না । রাফায়েলকে জড়িয়ে ধরলো । 
-তুমি কোথায় চলে গেছিলে আমাকে ছেড়ে !
-আমাকে যেতে হয়েছিলো । 
-আর কখনও যাবে না । মনে থাকবে !
-আচ্ছা যাবো না ! 

একটু শান্ত হলেই মিশু বলল
-জানো এই গাছ গুলো না আমাকে পালাতে সাহায্য করছে । কেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না । 
-কারন এগুলো ঠিক গাছ না । বলেছিলাম না তোমার সাহায্যের জন্য কেউ আছে !
অবাক হয়ে বলল 
-তাহলে কি ?
-এরা সবাই আগে মানুষ ছিল । মেয়ে ছিল । এখন এখানে বন্দী অবস্থায় আছে ! তোমার আপুও ঠিক এমনই হয়ে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে । আমি তোমাকে ছেড়ে তার কাছেই গিয়েছিলাম । অনেক দিন ধরেই সে আছে এই জন্য তার শরীর থেকে বেরিয়া আসা শিকড়টা কেটে দেওয়া দরকার ছিল নয়তো সে দ্রুত তার আগের জায়গাতে যেতে পারতো না । এখন বেশ দ্রুত হচ্ছে ট্রান্সফরমেশন ! 
-আমরা এদের কে সাহায্য করতে পারি না !
-না । সেই উপায় নেই । তোমার আপুকে সাহায্য করতে পারছি কারন তার বডি এখনও মারা যায় নি । এডের সবার বডি মারা গেছে । চল আমাদের এখানে আর থাকা ঠিক হচ্ছে না । 

কিন্তু ততক্ষনে একটু দেরি হয়ে গেছে । ঠিক যেভাবে উপর থেকে রাফায়েল এসে ঝাপিয়ে পড়েছিলো জুংগাও ঠিক ওদের সামনে এসে লাফিয়ে পড়লো । তারপর প্রথমেই রাফায়েলের হাত ধরে একটানে ওকে দুরে ছুড়ে ফেলে দিল । রাফায়েল কিছু করার আগেই দুরে ছিটকে পড়লো । 

মিশু একটু পিছিয়ে গিয়ে আবারও দৌড়াতে শুরু করে দিল । এবারও ঠিক পেছন থেকে সেই আসার আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছে । প্রতি মুহুর্তেই মনে হচ্ছে কেউ ওকে পেছন থেকে চেপে ধরবে । এই বুঝি ওকে ধরলো ! একটু একটু করে যেন ওর পেছনের আওজাটা কমে আসতে লাগলো । যখনই মনে হল ও এবারও পালাতে পারবে তখনই ও হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল । এবং আবিস্কার করলো জুংগা নামের সেই কুৎসিত প্রাণীটা ঠিক ওর সামনেই । ওর পক্ষে আর কোন ভাবেই পালানো সম্ভব না । জুংগার মুখের জায়গাতে আগে কিছু ছিল না । অনেকটা ফাকা মসৃন জাগয়ার মত ছিল । সেখানে একটা ফাঁকের মত সৃষ্টি হল । 
প্রাণীটা হাসছে ! 
কুৎসিত হাসিটা দেখে মিশুর গা ঘিন ঘিন করে উঠলো । জুংগা মিশুর এক পা চেপে ধরলো । চিৎকার দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হল না । একটা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে সেখানে জুংগা ধরেছে । 

রাফায়েল বলেছিল কোন ভাবেই জুংগার হাতে পরা যাবে না কিন্তু সেটা আর হল না বুঝি । যাক তবে এইটুকুই শান্তনা যে মিমি আপুকে ও মুক্ত করতে পেরেছে । 
জুংগা আরও একটু কাছে এল মিশুর । আরও যখন একটু এগিয়ে আসতে যাবে তখন ডান দিক এক একটা আওয়াজ এল । মিশু সেই সাথে জুংগাও সেদিকে ফিরে তাকালো । 

রাফায়েল ! 
তবে এবার সে আর খালি হাত নেই । লম্বা একটা বাঁশের মত লাঠি ওর হাত । রাফায়েল এক মুহুর্ত দেরী না করে নিজের যত শক্তি আছে ততশক্তি দিয়ে জুংগার মুখ বরাবর বাড়ি মারলো । থপ করে আওয়াজ হল । মিশু বুঝতে পারলো ওর পায়ের গোড়ালী ছেড়ে দিয়েছে জুংগা ! 

রাফায়েল এবার মিশুর হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করলো । এখনও হাতে লম্বা লাঠিটা রয়েছেই । একবার পেছন দিকে তাকিয়ে দেখে জুংগাও উঠে দাড়িয়েছে । ওদের দিকে চিৎকার করতে করতে গিয়ে আসছে । 

মিশুর কেবল মনে হচ্ছে ওকে দৌড়াতে হবে । পুকুরটা কোথায় ?
কোন দিকে !
ঐ তো দেখা যাচ্ছে । রাফায়েল ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-শুনো তোমার প্রথম কাজ হবে এখন সোজা গিয়ে পুকুরে ঝাপ দিবে ! ঠিক আছে !
দৌড়া দৌড়াতে বলল
-হ্যা ! 
-তারপর সাঁতরে উঠে পাড়ে দেখবে একটা মোমবাতি জ্বালানো আছে । আর ওটার পাশে একটা কালো বেড়াল মরে পরে আছে । তোমার কাজ হবে ওটা নিভিয়ে ফেলা এবং মরা বেড়ালটা পানির ভেতরে ফেলে দেওয়া । মনে থাকবে !
-তুমি ?
-আমার কথা চিন্তা করতে হবে না । তোমার কাজ হবে আগে দরজাটা বন্ধ করা । আমি যদি না বের হই তবুও । কারন জুংগা যদি দরজা দিয়ে বের হয়ে যায় তাহলে তোমাকে আবার যে টেনে নিয়ে যাবে এমন কি তোমার বোনকেও নিয়ে যেতে পারে । আমাদের সব পরিশ্রম বৃথা হয়ে যাবে !

মিশু কি বলবে বুঝতে পারলো না । হঠাৎ আবিস্কার করলো রাফায়েল থেমে গেছে । হাতে লাঠি নিয়ে জুংগাকে আটকানোর জন্য থেমে গেছে ! ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-তোমার চোখ দুটো আমার সেই ছোট বেলার প্রেমিকার মত । আমাকে মনে রেখো, কেমন !

এই বলে রাফায়েল হাসলো একটু ! মিশুর চোখ ফেটে কান্না এল । মন বলল থেমে গিয়ে ওকে সাথে নিয়ে যেতে । তখনই রাফায়েল চিৎকার করলো 
-যাও ! যাও বলছি ! 

মিশু আর কিছু ভাবলো না । সোজা পুকুরের ভেতরে ডাইভ দিয়ে পড়লো ! আবারও কয়েক মুহুর্ত সেই ঠান্ডা পানি ওকে চেপে ধরলো যেন তারপরেই ও পানি থেকে মাথা তুলে উঠলো । 

চারিদিকে নিকোস কালো অন্ধকার ! 
পরিচিত অন্ধকার ! 

এই অন্ধকারের ওর পরিচিত ! এটা ওর পরিচিত পৃথিবীর রাতের অন্ধকার ।

মিশির দ্রুত হাত পা চালালো । 
ওকে পাড়ে উঠতে হবে । ঐতো মোমটা জ্বলছে । ওটা নেভাতে হবে । গায়ের যত শক্তি আছে সেটা দিয়ে মিশি সাঁতরাতে থাকলো ! মনে মনে কেবল দোয়া করতে লাগলো রাফায়েল যেন মোমটা নেভানোর আগেই পানি থেকে ভেসে ওঠে ! 




পরিশিষ্টঃ

সপ্তাহ পার হয়ে গেছে । মিশুর বোন মিমির শরীরে আস্তে আস্তে শক্তি ফিরে আসছে । ডাক্তার এসেছিলো ওকে দেখতে । ওরা মিমির এতো প্রোগ্রেস দেখে সত্যিই অবাক হয়েছে । এটাকে একটা মিরাকেল বলেছে । বাসার সবার মন খুব ভাল । ওর বাবা আলতাম মাহমুদ পুরো গ্রামের মানুষকে পেট ভরে খাইয়েছে । 

রাফায়েলের পরিবারের খোজ করা হয়েছিল কিন্তু তার ব্যাপার কেয়ারটেকার কোন খোজ দিতে পারে নি । সে কেবল বলেছে যার যখন দরকার হয়ে যায় তখন রাফায়েল সেখানে হাজির হয়ে যায় ! সবার মন ভাল কেবল মিশুর বাদে । মিশুর মন খারাপ করে সেই পুকুর পাড়ে বসে থাকে এখন ! কারো সাথে ঠিক মত কথা বলে না ! জোবাইদা বেগমের বুঝতে কষ্ট হয় নি মেয়ের মন কেন খারাপ ! কিন্তু ভাগ্যের উপর কার হাত আছে ! 

ঐ দিনের পরে মিশুরদের পুকুর পাড়ে সবাই যেতে ভয় পায় কিন্তু মিশুর একদম ভয় পায় না । বরং বড় বেশি আপন মনে হয় জায়গাটা । ঐদিন মোমটা নেভানোর আগ পর্যন্তও মিশুর আশা ছিল রাফায়েল পানি থেকে মাথা তুলবে কিন্তু সে উঠে নি । প্রতিদিন বিকাল সন্ধ্যা মিশু এখানেই বসে থাকে । কেবল একটা আশা রাফায়েল হয়তো উঠে আসবে । কিন্তু আসে নি । ছেলেটা ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছে । জুংগার সাথে যুদ্ধ করে ও কোন ভাবেই টিকতে পারবে না । মারা পরবে । এই কথাটা মনে হতেই মিশুর খুব কান্না আসে ! 

-আফা মনি চা !

শিউলী চা রেখে গেল । মিশু চায়ে চুমুক দিতেই ওর মুখটা বিকৃত হয়ে উঠলো । শিউলীকে ধকম দিয়ে বলল
-চায়ে চিনি দিস নাই কেন ? জানিস না আমি চিনি ছাড়া আমি চা খাই না !
শিউলী যেন কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো । 
-কি যে কন না আফা ! আফনের চায়ে আমি চিনি দিমু না ? দুই চামুছ দিছি !

কথাটা শুনে মিশু চা টা মাটিতে ফেলে দিল । শিউলী আসলেই সত্যি কথা বলছে । চায়ের নীচে এখনও অগলিত চিনির দানা দেখা যাচ্ছে ! তাহলে প্রথম চুমুকে এমন পানছে কেন লাগলো !


লিখাঃ অপু তানভির ভাই

Comments

Popular posts from this blog

♦ কিভাবে #Conversation_skill বাড়াবেন??

কেন মানুষ প্রেমে পড়ে ? psychology প্রেম সম্বন্ধে কি বলে ?

যারা শুধু "বিসিএস ক্যাডার" হওয়াকেই মেধার মাপকাঠি বলে মনে করেন,তাদের জন্যই নিচের লেখাটি... :)